মঙ্গলবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪৯ অপরাহ্ন
রাজেকুজ্জামান রতন:
মানুষ জন্মের কারণে নয়, তার কর্মের ফলে বেঁচে থাকে। সেই যে প্রবাদ আছে না, বৃক্ষ তোমার নাম কী? উত্তরে বলা হয়েছিল নাম গুরুত্বপূর্ণ নয়, বৃক্ষের পরিচিতি তার ফলে। তেমনি মানুষের পরিচয় তার কর্মফলে। যে কারণে দেশবন্ধু, নেতাজি, মহাত্মা, বিশ্বকবি, বিদ্রোহী কবি, শেরে বাংলা, লাল মওলানা, বঙ্গবন্ধু এ রকম কত উপাধি শুনছি আমরা, যা তাদের নামকে ছাপিয়ে তাদের জীবন এবং কর্মকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে। পত্রিকার পাতায় তাদের নাম তাদের ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দিত পাঠকের মনে।
এখন পত্রিকার পাতা উজ্জ্বল করে রাখছেন কারা? তাদের বাবা-মায়ের দেওয়া নামের সঙ্গে তাদের অর্জিত উপাধি যুক্ত হয়ে একটা বিশেষ পরিচিতি তৈরি হয়েছে। তবে সেই পরিচিতি এবং উপাধিগুলো একটু অন্যরকম। এ রকম কিছু বিখ্যাত নাম হচ্ছে মুরগি মিলন, কালা জাহাঙ্গীর, লেদার লিটন, টোকাই সাগর, সুইডেন আসলাম, পিচ্চি হান্নান প্রমুখ। এ ছাড়া গত তিন দশকে দেশে বেশ কিছু আলোচিত নাম সংবাদপত্রের কল্যাণে দেশবাসী জানতে পেরেছে। তাদের মধ্যে নামজাদারা হচ্ছেন ডগ শিশির, চুই বাবু, জাপানি কিংবা প্যালেস্টাইন বাবু, ছ্যাঁচড়া কামাল, ভেতো শাহীন, কিলার আব্বাস, নাটকা বাবু, গিট্টু নাসির, শ্যুটার লিটন, টুণ্ডা জলিল, বোস্কামারা কবির, জংলি শামীম, ডিব্বা হারুন, আন্ডা দেলু, চোট্টা হাইবা, চিকা হারুন, চিটার হারুন, বাস্টার্ড সেলিম, ল্যাংটা করিম, সেঞ্চুরি মানিক, খচ্চর হাবিব, পকেট রফিক, ডাইনিং বাবু, ঠ্যাক খাইরু, ক্ষুর হাদিছ, টুণ্ডা হারুন, টুটু বাবু, কুইড়া কবীর, নুলা লিয়াকত, ফেনসি পাপন, চীনা রফিক ও ডাইল খোকন। শুনতে ভালো না লাগলেও এসব উপাধি তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, কাজের ক্ষেত্র এবং কর্মদক্ষতার পরিচয় তুলে ধরে। এর ফলে নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মানুষের ভিড়েও তাদের চেনা যায়।
এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন গোল্ডেন মনির। সর্বশেষ অর্থ শেষ নয়, বুঝতে হবে আপাতত। যখন প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার যুগ ছিল তখন মানুষ অপেক্ষায় থাকত পরের ছবি কোনটা তা জানতে। সিনেমার বিজ্ঞাপনে তখন ভেসে উঠত ‘আসিতেছে’! এখন প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখা কমে গেছে, তাই বাস্তবে সিনেমার চেয়েও অবিশ্বাস্য, রূপকথার চেয়েও রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটছে। কত নাম আর কী অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদ আমরা প্রত্যক্ষ করছি প্রতিনিয়ত।
২১ নভেম্বর সকালে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তার বাসা থেকে ৬০০ ভরি স্বর্ণ, বিদেশি পিস্তল-গুলি, মদ, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও ১ কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। এ ছাড়া, তার বাড়ি থেকে অনুমোদনহীন দুটি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়, যার প্রতিটির বাজারমূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। তার ‘অটো কার সিলেকশন’ নামের গাড়ির শোরুম থেকে আরও তিনটি অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়। তবে এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১২ সালে দুদক মনিরের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা করেছিল। দুদক বলছে, সেই মামলার তদন্ত এখনো চলছে! তাদের অনুসন্ধানে মনির ও তার স্ত্রীর ৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। আর এ পর্যন্ত র্যাবের অভিযানের টাকা, সম্পদ ও যে পাঁচটি গাড়ি জব্দ হয়েছে, তার মূল্য ৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। র্যাবের মুখপাত্র কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, তারা প্রাথমিক অনুসন্ধানে গোল্ডেন মনিরের ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার সম্পদ এবং ২০২টি প্লট ও বাড়ির তথ্য পেয়েছেন। তিনি জানান, আমরা অবৈধ মাদকের তথ্যের ভিত্তিতে তার বাড়িতে অভিযান চালাই। এরপর কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। তার ২৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে ৯৫০ কোটি টাকা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দেখে একটু অবাক হতে হয়, কারণ একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে কত তথ্য লাগে। যারা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করেন তারা সবাই সেটা জানেন। কিন্তু মনিরদের কাছে তা যেন জলবৎ তরলং। গোল্ডেন মনিরের উত্থান কিন্তু আকস্মিক নয়। অনেক আগে থেকেই তার বিরুদ্ধে দুদকের এবং রাজউকের একটি করে মামলা রয়েছে। গাউছিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা মনির মূলত একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী ও স্বর্ণের চোরাকারবারি। এ থেকেই মনির পরিচিতি পান ‘গোল্ডেন মনির’ হিসেবে। বন্ধুরা সবাই জানতেন তার এই পরিচিতি। কিন্তু যাদের জানার কথা তারা কি জানতেন না?
মনির জিজ্ঞাসাবাদে জানান, এক কথায় হাতে তুড়ি দিয়ে সব কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। অর্থ যেভাবে দেদার কামিয়েছেন, আবার খরচও করেছেন অকাতরে। নিজের কাজের জন্য কাউকে পথের কাঁটা মনে করলে তাকে পদ থেকে সরাতে সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বন করতেন তিনি। বিভিন্ন সময় নিজের ক্ষমতা ও আর টাকার জোরে অনেককে সরাতেও সক্ষম হন। তবে কাজ আদায় করতে টোপ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘মাথা কিনে নেওয়ার’ নীতি ছিল তার। মনির জিজ্ঞাসাবাদে রাজউক ও গণপূর্তের বিভিন্ন কাজ জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি এও জানান, একা নন এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, যারা সুবিধা নিয়ে তার ফাইল পাস করিয়ে দিতেন। বিভিন্ন আমলে তার সুবিধাভোগী কয়েকজন কর্মকর্তার নামও প্রকাশ করেছেন মনির। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সব সময় বলতে পছন্দ করেন, এরা সব বিচ্ছিন্ন অপরাধী, এদের কোনো দল নেই। কিন্তু বাস্তবে এরা ক্ষমতাসীন দল ছাড়া থাকতেই পারেন না এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনেকের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ১৯৯৪ থেকে ২০২০ যারা ক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন, মনির ছিল সবার সঙ্গে।
একটু ভেবে দেখলে বলতে হয় গোল্ডেন মনির আসলেই গোল্ডেনম্যান। এভাবে বুদ্ধি খাঁটিয়ে সামান্য থেকে অসামান্য হওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। দেশের কৃষক শ্রমিকের কথা বাদই দিলাম, সাধারণ মধ্যবিত্তরাও দিন-রাত পরিশ্রম করে, সারাক্ষণ যে আচ্ছন্নের মতো ছুটতে থাকে দুটো টাকা রোজগারের জন্য, সে তো জীবনে অর্থ-বিত্ত-প্রতিষ্ঠার জন্যই। কিন্তু কজন তা পারে? মনির সেটা করতে পেরেছেন। তিনি ‘ডগ’ কিংবা ‘মুরগি’ নন, উপাধিটাও পেয়েছেন বেশ লাগসই ‘গোল্ডেন মনির’।
এটা মনে হওয়া দোষের নয় যে, গোল্ডেন মনিরের বোকার মতো ধরা পড়াটা মোটেও উচিত হয়নি। আর একটু সাবধান তিনি হতে পারতেন। নাকি যেদিকে তাকাই সব আমার লোক এই ভাবনায় তিনি আত্মগর্বী হয়েছিলেন। সম্পদ যে সমাজে সাফল্যের মাপকাঠি সে সমাজে তিনি সাফল্যের একটা অনন্য দৃষ্টান্তেপরিণত হচ্ছিলেন। অ্যানালগ ও ডিজিটাল উভয় পদ্ধতি ব্যবহার করে প্লট-সংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র চুরি করে এবং অবৈধভাবে রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তার দাপ্তরিক সিল ব্যবহার করে রাজউক, পূর্বাচল, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে বিপুলসংখ্যক প্লট বাগিয়ে নেওয়াটা কি চাট্টিখানি কাজ? আর কিছুটা সুযোগ পেলে বা করোনার ঝামেলাটা না হলে আরও কত সাফল্যের পালক যে যুক্ত হতো তার মুকুটে, এটা এখন শুধু কল্পনাই করতে পারি আমরা। আর শুধু সোনা নয়, মাথাপিছু আয় যেভাবে বাড়ছে তাতে দেশে হীরার ব্যবহার বাড়বে নিশ্চয়। হীরার ব্যবসা করার সুযোগ পেলে এবং হীরা নিয়ে জাদুকরী ক্ষমতা দেখালে তার উপাধি ‘ডায়মন্ড মনির’ হতে পারত। একটা সুচতুর এবং সক্রিয় মানুষের সম্ভাবনাকে এভাবে খ্যাতির মধ্য গগনে ধ্বংস করে দেওয়া কি ঠিক হলো?
আমাদের দেশ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বিস্ময়করভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মুরগি মিলন, ডগ শিশির, লেদার লিটন, কালা জাহাঙ্গীর কিংবা গোল্ডেন মনিরদের সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি ঈর্ষণীয়। এমন জিরো থেকে হিরো হওয়ার উদার লীলাভূমি পৃথিবীতে আর কি আছে? সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে এদের বীরত্ব, অসাধারণত্ব, সামান্য থেকে অসামান্য হওয়ার দুর্দান্ত সব গল্প। রূপকথার নায়ক বলুন, অলৌকিক মানুষ বলুন আর মহাপুরুষই বলুন, বর্তমানকালে গোল্ডেন মনিররাই সবকিছু। রাজধানীতে, বন্দরনগরীতে, জেলা শহরে, গ্রামগঞ্জে কোথায় নেই তারা? তাদের কেউ কেউ কথা নয় দেশের জন্য কাজ করতে হবে এমন সব বাণী দিচ্ছেন, মাননীয় নেতানেত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলছেন, তাদের সেসব বাণী ও ছবি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। তারপর এই তারাই নিরীহ লোকজনের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, জমি দখল করছে, ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে, অপহরণ করছে, ধর্ষণ করছে, নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে, প্রতিপক্ষের এক-দুজন রাজনৈতিক কর্মীকে অবলীলায় খুন করছে, দলের মধ্যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলে তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করছে।
প্রশ্ন আসে, তাহলে এরা ধরা পড়ছে বা ধরা হচ্ছে কেন? উৎপাদন বেশি হয়ে গেলে গুদামে জায়গা সংকুলান হয় না, এজন্য মাঝেমধ্যে গুদাম খালি করতে হয়। এই গুদাম খালির দায়িত্ব পালন করছে সরকার। মাঝেমধ্যে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে দু-একজন বিশিষ্টকে ধরে ফেলা হচ্ছে। কড়া(!) নজরদারি সত্ত্বেও পেতে রাখা জাল থেকে দু-চারজন লাফিয়ে ওঠা মাছের মতো বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছেন, দুর্ঘটনাবশত কেউ হয়তো পরপারে চলে যাচ্ছেন। এসব দেখে মনে হচ্ছে যাক! শেষ হলো, কিন্তু না। সেই ঘাটতি সঙ্গে সঙ্গেই পূরণ হয়ে যাচ্ছে। কারণ দেশে এমন ‘গোল্ডেন মনির’ তৈরির মেশিন শুধু চালু আছে তা নয়, পূর্ণমাত্রায় সচল আছে। মনিররা ধরা পড়েছে তবে মেশিন যেহেতু চালু আছে, ফলে এটা হয়তো সর্বশেষ কিন্তু শেষ নয়। ভবিষ্যতে আরও আসিতেছে!
মানুষ জন্মের কারণে নয়, তার কর্মের ফলে বেঁচে থাকে। সেই যে প্রবাদ আছে না, বৃক্ষ তোমার নাম কী? উত্তরে বলা হয়েছিল নাম গুরুত্বপূর্ণ নয়, বৃক্ষের পরিচিতি তার ফলে। তেমনি মানুষের পরিচয় তার কর্মফলে। যে কারণে দেশবন্ধু, নেতাজি, মহাত্মা, বিশ্বকবি, বিদ্রোহী কবি, শেরে বাংলা, লাল মওলানা, বঙ্গবন্ধু এ রকম কত উপাধি শুনছি আমরা, যা তাদের নামকে ছাপিয়ে তাদের জীবন এবং কর্মকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে। পত্রিকার পাতায় তাদের নাম তাদের ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল উপস্থিতি জানান দিত পাঠকের মনে।
এখন পত্রিকার পাতা উজ্জ্বল করে রাখছেন কারা? তাদের বাবা-মায়ের দেওয়া নামের সঙ্গে তাদের অর্জিত উপাধি যুক্ত হয়ে একটা বিশেষ পরিচিতি তৈরি হয়েছে। তবে সেই পরিচিতি এবং উপাধিগুলো একটু অন্যরকম। এ রকম কিছু বিখ্যাত নাম হচ্ছে মুরগি মিলন, কালা জাহাঙ্গীর, লেদার লিটন, টোকাই সাগর, সুইডেন আসলাম, পিচ্চি হান্নান প্রমুখ। এ ছাড়া গত তিন দশকে দেশে বেশ কিছু আলোচিত নাম সংবাদপত্রের কল্যাণে দেশবাসী জানতে পেরেছে। তাদের মধ্যে নামজাদারা হচ্ছেন ডগ শিশির, চুই বাবু, জাপানি কিংবা প্যালেস্টাইন বাবু, ছ্যাঁচড়া কামাল, ভেতো শাহীন, কিলার আব্বাস, নাটকা বাবু, গিট্টু নাসির, শ্যুটার লিটন, টুণ্ডা জলিল, বোস্কামারা কবির, জংলি শামীম, ডিব্বা হারুন, আন্ডা দেলু, চোট্টা হাইবা, চিকা হারুন, চিটার হারুন, বাস্টার্ড সেলিম, ল্যাংটা করিম, সেঞ্চুরি মানিক, খচ্চর হাবিব, পকেট রফিক, ডাইনিং বাবু, ঠ্যাক খাইরু, ক্ষুর হাদিছ, টুণ্ডা হারুন, টুটু বাবু, কুইড়া কবীর, নুলা লিয়াকত, ফেনসি পাপন, চীনা রফিক ও ডাইল খোকন। শুনতে ভালো না লাগলেও এসব উপাধি তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, কাজের ক্ষেত্র এবং কর্মদক্ষতার পরিচয় তুলে ধরে। এর ফলে নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মানুষের ভিড়েও তাদের চেনা যায়।
এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন গোল্ডেন মনির। সর্বশেষ অর্থ শেষ নয়, বুঝতে হবে আপাতত। যখন প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার যুগ ছিল তখন মানুষ অপেক্ষায় থাকত পরের ছবি কোনটা তা জানতে। সিনেমার বিজ্ঞাপনে তখন ভেসে উঠত ‘আসিতেছে’! এখন প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখা কমে গেছে, তাই বাস্তবে সিনেমার চেয়েও অবিশ্বাস্য, রূপকথার চেয়েও রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটছে। কত নাম আর কী অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদ আমরা প্রত্যক্ষ করছি প্রতিনিয়ত।
২১ নভেম্বর সকালে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সময় তার বাসা থেকে ৬০০ ভরি স্বর্ণ, বিদেশি পিস্তল-গুলি, মদ, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও ১ কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। এ ছাড়া, তার বাড়ি থেকে অনুমোদনহীন দুটি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়, যার প্রতিটির বাজারমূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। তার ‘অটো কার সিলেকশন’ নামের গাড়ির শোরুম থেকে আরও তিনটি অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়। তবে এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১২ সালে দুদক মনিরের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা করেছিল। দুদক বলছে, সেই মামলার তদন্ত এখনো চলছে! তাদের অনুসন্ধানে মনির ও তার স্ত্রীর ৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। আর এ পর্যন্ত র্যাবের অভিযানের টাকা, সম্পদ ও যে পাঁচটি গাড়ি জব্দ হয়েছে, তার মূল্য ৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। র্যাবের মুখপাত্র কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, তারা প্রাথমিক অনুসন্ধানে গোল্ডেন মনিরের ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার সম্পদ এবং ২০২টি প্লট ও বাড়ির তথ্য পেয়েছেন। তিনি জানান, আমরা অবৈধ মাদকের তথ্যের ভিত্তিতে তার বাড়িতে অভিযান চালাই। এরপর কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। তার ২৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে ৯৫০ কোটি টাকা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দেখে একটু অবাক হতে হয়, কারণ একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে কত তথ্য লাগে। যারা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করেন তারা সবাই সেটা জানেন। কিন্তু মনিরদের কাছে তা যেন জলবৎ তরলং। গোল্ডেন মনিরের উত্থান কিন্তু আকস্মিক নয়। অনেক আগে থেকেই তার বিরুদ্ধে দুদকের এবং রাজউকের একটি করে মামলা রয়েছে। গাউছিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা মনির মূলত একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী ও স্বর্ণের চোরাকারবারি। এ থেকেই মনির পরিচিতি পান ‘গোল্ডেন মনির’ হিসেবে। বন্ধুরা সবাই জানতেন তার এই পরিচিতি। কিন্তু যাদের জানার কথা তারা কি জানতেন না?
মনির জিজ্ঞাসাবাদে জানান, এক কথায় হাতে তুড়ি দিয়ে সব কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। অর্থ যেভাবে দেদার কামিয়েছেন, আবার খরচও করেছেন অকাতরে। নিজের কাজের জন্য কাউকে পথের কাঁটা মনে করলে তাকে পদ থেকে সরাতে সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বন করতেন তিনি। বিভিন্ন সময় নিজের ক্ষমতা ও আর টাকার জোরে অনেককে সরাতেও সক্ষম হন। তবে কাজ আদায় করতে টোপ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘মাথা কিনে নেওয়ার’ নীতি ছিল তার। মনির জিজ্ঞাসাবাদে রাজউক ও গণপূর্তের বিভিন্ন কাজ জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি এও জানান, একা নন এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, যারা সুবিধা নিয়ে তার ফাইল পাস করিয়ে দিতেন। বিভিন্ন আমলে তার সুবিধাভোগী কয়েকজন কর্মকর্তার নামও প্রকাশ করেছেন মনির। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সব সময় বলতে পছন্দ করেন, এরা সব বিচ্ছিন্ন অপরাধী, এদের কোনো দল নেই। কিন্তু বাস্তবে এরা ক্ষমতাসীন দল ছাড়া থাকতেই পারেন না এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনেকের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ১৯৯৪ থেকে ২০২০ যারা ক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন, মনির ছিল সবার সঙ্গে।
একটু ভেবে দেখলে বলতে হয় গোল্ডেন মনির আসলেই গোল্ডেনম্যান। এভাবে বুদ্ধি খাঁটিয়ে সামান্য থেকে অসামান্য হওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। দেশের কৃষক শ্রমিকের কথা বাদই দিলাম, সাধারণ মধ্যবিত্তরাও দিন-রাত পরিশ্রম করে, সারাক্ষণ যে আচ্ছন্নের মতো ছুটতে থাকে দুটো টাকা রোজগারের জন্য, সে তো জীবনে অর্থ-বিত্ত-প্রতিষ্ঠার জন্যই। কিন্তু কজন তা পারে? মনির সেটা করতে পেরেছেন। তিনি ‘ডগ’ কিংবা ‘মুরগি’ নন, উপাধিটাও পেয়েছেন বেশ লাগসই ‘গোল্ডেন মনির’।
এটা মনে হওয়া দোষের নয় যে, গোল্ডেন মনিরের বোকার মতো ধরা পড়াটা মোটেও উচিত হয়নি। আর একটু সাবধান তিনি হতে পারতেন। নাকি যেদিকে তাকাই সব আমার লোক এই ভাবনায় তিনি আত্মগর্বী হয়েছিলেন। সম্পদ যে সমাজে সাফল্যের মাপকাঠি সে সমাজে তিনি সাফল্যের একটা অনন্য দৃষ্টান্তেপরিণত হচ্ছিলেন। অ্যানালগ ও ডিজিটাল উভয় পদ্ধতি ব্যবহার করে প্লট-সংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র চুরি করে এবং অবৈধভাবে রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তার দাপ্তরিক সিল ব্যবহার করে রাজউক, পূর্বাচল, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে বিপুলসংখ্যক প্লট বাগিয়ে নেওয়াটা কি চাট্টিখানি কাজ? আর কিছুটা সুযোগ পেলে বা করোনার ঝামেলাটা না হলে আরও কত সাফল্যের পালক যে যুক্ত হতো তার মুকুটে, এটা এখন শুধু কল্পনাই করতে পারি আমরা। আর শুধু সোনা নয়, মাথাপিছু আয় যেভাবে বাড়ছে তাতে দেশে হীরার ব্যবহার বাড়বে নিশ্চয়। হীরার ব্যবসা করার সুযোগ পেলে এবং হীরা নিয়ে জাদুকরী ক্ষমতা দেখালে তার উপাধি ‘ডায়মন্ড মনির’ হতে পারত। একটা সুচতুর এবং সক্রিয় মানুষের সম্ভাবনাকে এভাবে খ্যাতির মধ্য গগনে ধ্বংস করে দেওয়া কি ঠিক হলো?
আমাদের দেশ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বিস্ময়করভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মুরগি মিলন, ডগ শিশির, লেদার লিটন, কালা জাহাঙ্গীর কিংবা গোল্ডেন মনিরদের সৃষ্টি ও বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি ঈর্ষণীয়। এমন জিরো থেকে হিরো হওয়ার উদার লীলাভূমি পৃথিবীতে আর কি আছে? সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হচ্ছে এদের বীরত্ব, অসাধারণত্ব, সামান্য থেকে অসামান্য হওয়ার দুর্দান্ত সব গল্প। রূপকথার নায়ক বলুন, অলৌকিক মানুষ বলুন আর মহাপুরুষই বলুন, বর্তমানকালে গোল্ডেন মনিররাই সবকিছু। রাজধানীতে, বন্দরনগরীতে, জেলা শহরে, গ্রামগঞ্জে কোথায় নেই তারা? তাদের কেউ কেউ কথা নয় দেশের জন্য কাজ করতে হবে এমন সব বাণী দিচ্ছেন, মাননীয় নেতানেত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলছেন, তাদের সেসব বাণী ও ছবি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। তারপর এই তারাই নিরীহ লোকজনের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, জমি দখল করছে, ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে, অপহরণ করছে, ধর্ষণ করছে, নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে, প্রতিপক্ষের এক-দুজন রাজনৈতিক কর্মীকে অবলীলায় খুন করছে, দলের মধ্যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলে তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করছে।
প্রশ্ন আসে, তাহলে এরা ধরা পড়ছে বা ধরা হচ্ছে কেন? উৎপাদন বেশি হয়ে গেলে গুদামে জায়গা সংকুলান হয় না, এজন্য মাঝেমধ্যে গুদাম খালি করতে হয়। এই গুদাম খালির দায়িত্ব পালন করছে সরকার। মাঝেমধ্যে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে দু-একজন বিশিষ্টকে ধরে ফেলা হচ্ছে। কড়া(!) নজরদারি সত্ত্বেও পেতে রাখা জাল থেকে দু-চারজন লাফিয়ে ওঠা মাছের মতো বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছেন, দুর্ঘটনাবশত কেউ হয়তো পরপারে চলে যাচ্ছেন। এসব দেখে মনে হচ্ছে যাক! শেষ হলো, কিন্তু না। সেই ঘাটতি সঙ্গে সঙ্গেই পূরণ হয়ে যাচ্ছে। কারণ দেশে এমন ‘গোল্ডেন মনির’ তৈরির মেশিন শুধু চালু আছে তা নয়, পূর্ণমাত্রায় সচল আছে। মনিররা ধরা পড়েছে তবে মেশিন যেহেতু চালু আছে, ফলে এটা হয়তো সর্বশেষ কিন্তু শেষ নয়। ভবিষ্যতে আরও আসিতেছে!
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট
rratan.spb@gmail.com
লেখক রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামনিস্ট
rratan.spb@gmail.com